রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৬ অপরাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদক : রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের রাস্তার ধারের অংশে এক সারিতে ১০-১২টি মুরগির দোকান। ওই সারির সাবিতা খাতুন মুরগির দোকানে তিন কর্মীকে ব্যস্ত দেখা যায় ক্রেতার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মুরগি জবাই ও ড্রেসিং করার কাজে।
দুজন মিলে পর পর ছয়টি মুরগি জবাই করে একে একে রাখল একটি ড্রামের মধ্যে। ড্রামের মুখের বাইরের অংশে ইঞ্চি দুয়েকের মতো পুরু হয়ে লেগে আছে ময়লা। ড্রামের ভেতরেও বারবার জবাই করা মুরগির রক্তসহ বর্জ্য পড়ে আছে। একই অবস্থা সারির অন্যান্য দোকানেও। পাশের রাস্তাটিও মুরগির রক্ত, বর্জ্যে একাকার।
দোকানগুলোর কর্মচারীরা প্রতিটি মুরগি জবাই করে প্রথমে ড্রামের মধ্যে রাখে। মুরগি লাফালাফি বন্ধ করে অসাড় হয়ে পড়লে আরেক কর্মচারী সেটি বের করে টিনের তৈরি একটি স্ট্রেচারে রাখে। স্ট্রেচারটিতেও জমাট বাঁধা রক্তমাখা। এক পাশে আগে জবাই করা মুরগির চামড়া, নাড়িভুঁড়ি, পা, পাখনা স্তূপ করে রাখা।
কর্মচারীরা খালি হাতেই ড্রাম থেকে একটি করে মুরগি বের করে আর স্ট্রেচারের ওপর রেখে চামড়া, নাড়িভুঁড়ি ছাড়িয়ে পলিথিনে ভরে গ্রাহকের হাতে তুলে দেয়।
ওই সব দোকানে যে ড্রামগুলোতে জবাই করা মুরগি রাখা হয় সেগুলো রক্ত-পানিতে ভরে গেলে রাস্তার পাশের ড্রেনে ড্রাম কাত করে ময়লা ফেলে দেওয়া হয়। ড্রাম আর ধোয়া হয় না। ফলে ড্রামগুলোর ভেতরে-বাইরে ময়লার স্তর জমে যায়। এতে মুরগিতে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এমনিতেই দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে হলে নাক-মুখ বন্ধ করে যেতে হয়। পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জানতে চাইলে এক দোকানের কর্মী মামুন বলেন, ‘ভাই রাইতের বেলা সব ধোয়া হয়। আবার সকালে দোকান খোলার সময় ধোয়া হয়। ’ দুই বেলা ড্রাম পরিষ্কার করলে ময়লার স্তর জমে থাকার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রক্ত জমে যায় তো। সহজে পরিষ্কার হয় না। ’
২০০৮-০৯ সালে বার্ড ফ্লুর সংক্রমণ নিয়ে হুলুস্থুলের সময় মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার ও নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারের মুরগির দোকানগুলোকে মডেল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন যেসব নিয়ম মেনে চলতে বলা হয়েছিল এখন তা আর মানা হচ্ছে না। টাউন হল কাঁচাবাজারের মুরগির দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকটি দোকানের মাঝখানে একটি ছোট কাচের ঘর। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক পানির ব্যবস্থা রয়েছে। মুরগি জবাই করার স্থানও আলাদা। কিন্তু এখন কাচের ঘরটি আর খুব একটা ব্যবহার করা হয় না। দোকানের কর্মীরাও নির্দিষ্ট পোশাক, হাতে গ্লাভস পরছে না।
ওই বাজারের ফরেন চিকেন হাউসের এক কর্মচারী বলে, ‘যখন মডেল ঘোষণা করা হয়েছিল তখন ড্রেস পরতে হয়েছে। এখন আর দরকার হয় না। কেউ কেউ কাচ ঘেরা রুমে জবাই করে, আবার অনেকে বাইরেই করে। ’ ধানমণ্ডি, ফার্মগেট, সেগুনবাগিচা, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মুরগির দোকানগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেছে।
ঢাকায় বিভিন্ন সুপার শপে ড্রেসিং করা মুরগি সুন্দর প্যাকেটে করে সাজিয়ে রাখা হয়। ফলে জানার উপায় নেই, কোথায় কোন পরিবেশে মুরগি জবাই ও ড্রেসিং করা হয়েছে। তবে স্বপ্ন সুপার শপে একটু নতুনত্ব যোগ হয়েছে। মোহাম্মদপুর টাউন হলের পাশে স্বপ্নের আউটলেটে দেখা গেছে, সাপ্লাইয়ের মুরগি নিতে কারো আপত্তি থাকলে জ্যান্ত মুরগি জবাই করে দেওয়া হয়। এর জন্য আলাদা একটি রুম রয়েছে। সেখানে জবাই, ড্রেসিং পরিচ্ছন্নভাবে করা হয়। কর্মীদের সার্বক্ষণিক ড্রেসকোডও আছে। ওই আউটলেটের অপারেশন ম্যানেজার মো. ফয়সাল মাহমুদ কালের খবরকে বলেন, ‘জবাইয়ের নির্ধারিত কক্ষটি পুরো আলাদা এবং পরিচ্ছন্ন। আর যে ড্রামের ওপর মুরগি জবাই করা হয় সেটি দুই ঘণ্টা পর পর পরিষ্কার করা হয়। এটা গ্রাহকের সামনেই করা হয়। ’
কয়েক বছর আগে রাজধানীর মুরগির দোকানগুলোর কর্মীদের পোশাক ও হাতের গ্লাভস দিয়েছিল সিটি করপোরেশন। বার্ড ফ্লুর ঝুঁকি কমে যাওয়ার পর থেকে দোকানিরা সেসব ব্যবহার করা বাদ দিয়েছেন। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু বার্ড ফ্লু নয়, বর্তমানে যে পরিবেশে যে প্রক্রিয়ায় মুরগি জাবাই করে বিক্রি করা হচ্ছে সেখান থেকে নানা রোগ ছড়াতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক এবং এফএওর নিরাপদ খাদ্য গবেষণাবিষয়ক কার্যক্রমের উপদেষ্টা ডা. মো. শাহ মনির হোসেন কালের খবরকে বলেন, ‘একটা সময় নিয়মের মধ্যে চেষ্টা করে লাভ হয়নি। এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ সমস্যা। দূষিত পানিতে নানা ধরনের ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস থাকে, যার মাধ্যমে শুধু বার্ড ফ্লু নয়, নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রকট। তবে ঢাকার বাইরে যশোর, গাজীপুরসহ কয়েকটি স্থানে কাজ করে কিছুটা পরিবর্তন আসছে। ’
জানা গেছে, মুরগি বা অন্য যেকোনো প্রাণীর মাংসের বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) একটি গাইডলাইন তৈরির কাজ করছে। এতে বড় একটি নির্দেশনা থাকবে মুরগির বাজার নিয়ে। বিএফএসএ সূত্রে জানা গেছে, গাইডলাইনটিতে ব্যবহার করার পানি কোনদিক থেকে ঢুকে কোনদিকে বের হবে, নির্ধারিত কক্ষের বাতাস কোনদিকে বের হবে, মানুষের দোকানে ঢোকা ও বেরোনোর আলাদা রাস্তা, মুরগি ঢোকানোর আলাদা রাস্তা, কয়েকটি ধাপে কাজ করার জন্য বিক্রেতাদের ভিন্ন ভিন্ন রঙের ড্রেসকোড ব্যবহারের নির্দেশনা থাকবে।
এ বিষয়ে বিএফএসএর সদস্য প্রফেসর ডা. মো. ইকবাল রউফ মামুন কালের খবরকে বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করছি। শুধু গাইডলাইন নয়, তাদের ট্রেনিংও দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এর পরও কেউ কথা না শুনলে তখন শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। ’
গাইডলাইন তৈরির সঙ্গে জড়িত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আজমত আলী কালের খবরকে বলেন, ‘আমরা নিউ মার্কেট ও টাউনহলে দুটি মডেল বাজার করেছিলাম। কিন্তু সেগুলোর চেহারা আবার আগের মতোই হয়েছে। আমরা তাদের কথা শোনাতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে গাইডলাইন হলে নতুন করে কাজ শুরু হবে। তখন আমরা আর ছাড় দেব না। ’
বিভিন্ন দেশে উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে ৮-১০টি ধাপ মেনে তারপর মাংস পৌঁছে দেওয়া হয় ক্রেতার হাতে। প্রতিটি ধাপে পরিচ্ছন্নতা ও মান নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সর্বশেষ ধাপে পুনরায় কোনো জীবাণু রয়েছে কি না তা পরীক্ষা করার পরই প্যাকেজিং করে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
কালের খবর -/১/৩/১৮